top of page

কিডনির অসুখ বংশগত হতে পারে!

  • সুস্বাস্থ্য প্রকাশনা
  • Jun 30
  • 10 min read

Updated: Jul 1

ডাঃ শৌভিক সুরাল

(বিশিষ্ট কিডনি বিশেষজ্ঞ)

ree

কিডনি মানুষের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কারণ শরীরে উৎপন্ন হওয়া কিছু বর্জ্য যা স্বাভাবিক ক্রিয়ায় শরীর থেকে নিষ্কাশিত হয়, সেক্ষেত্রে ছাঁকনির কাজ করে। এই কিডিনি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মানব শরীরের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং বাড়াবাড়ি পর্যায়ে জীবনহানিও ঘটতে পারে। আগে চিকিৎসা বিদ্যায় ‘কিডনি ফেলিওর’ কথাটি ব্যবহার করা হত। কিন্তু এতে সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা গিয়ে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উঠতে পারে ভেবেই এখন ‘ফেলিওর’ শব্দটি তুলে দিয়ে আমরা বলি ‘কিডনি ডিজিজ’। আজকের প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘কিডনির অসুখ’।


কিডনির অসুখের প্রকারভেদ

কিডনির অসুখকে প্রকৃতি অনুযায়ী দু’ ভাগে ভাগ করা যায়-অ্যাকিউট কিডনি ডিজিজ এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজ।


মানুষের শরীরে কিডনির মধ্যেকার ইউনিট হল গ্লোমেরুলাস। এই গ্লোমেরুলাসের মাধ্যমে কিডনির মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন প্রস্রাব নির্গত হয়। কিডনির সুস্থতার পরিমাপ করতে হলে একটা নির্দিষ্ট পরীক্ষা আছে যাকে বলা হয় গ্লোমেরুলার ফিল্টারেশন রেট বা জি.এফ.আর। এর স্বাভাবিক রেট হল 120। এবার যদি এর থেকে রেটটা কমতে থাকে তবে সেটা কিডনির অসুখের দিকে যায়। আগেই বলেছি যে কিডনির অসুখের দুটি ভাগ--অ্যাকিউট ও ক্রনিক। এই দুই ধরনের অসুখেরই নিজস্ব কিছু কারণ আছে।


ক্রনিক কিডনি ডিজিজের প্রকৃতি:

এই অসুখর কতকগুলি ধাপ আছে। যেমন,

স্টেজ ওয়ান--জি.এফ.আর--120-90

স্টেজ টু--জি.এফ.আর--90-60

স্টেজ থ্রি--জি.এফ.আর--60-30

স্টেজ ফোর--জি.এফ.আর--30-15

স্টেজ ফাইভ--জি.এফ.আর--15-র নীচে


এক্ষেত্রে, যদি অসুখটাকে স্টেজ ওয়ানে নির্ধারণ করা যায় তাহলে আমরা ওষুধ দিয়ে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি এবং লক্ষ থাকে যাতে পরবর্তী স্তরগুলোতে অসুখ পৗঁছে না যায়।

ree

ক্রনিক কিডনি অসুখের কারণ

বিদেশে বা এদেশে যেখানেই হোক কিডনির অসুখের মূল কারণ মধুমেহ বা ডায়াবেটিস। এই অসুখে যদি শর্করা নিয়ন্ত্রিত না খাকে বা দীর্ঘদিন শর্করার মাপ বেশ উঁচুতে থাকে তবে তা কিডনির ওপর প্রভাব ফেলে। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে রাখি যে, শর্করা পরিমাপের ক্ষেত্রে সাধারণত দু’ ধরনের রক্ত পরীক্ষা আছে। একটা খালিপেটে, অন্যটা খাওয়ার পরে। এটা অনেকেই করে থাকেন। তাতে শর্করার পরিমাণ কখনো বেশি বা কম হতে পারে। তবে সব থকে গুরুত্বপূর্ণ হল আরও একটি রক্ত পরীক্ষা যার নাম এইচ.বি.এ1সি । এর মাধ্যমে 3 মাসের শর্করার পরিমাপ এবং শরীরে শর্করার সার্বিক পরিমাপ করা সম্ভব হয়। তাই এক্ষেত্রে যদি ডায়াবেটিস রোগীর এই পরীক্ষার পরিমাপ 7-এর নীচে হয় তবে তার কিডনির অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি কম হয়।


উচ্চ রক্তচাপ এমন একটি বিষয় যার প্রভাব কিডনির ওপরে পড়ে। এ সম্পর্কে আমার মত হল যেকোনো বয়সেই রক্তচাপ 140/80 বা 130/80 হলে ভালো। প্রোটিন নির্গমনের সমস্যা থাকলে রক্তচাপ 130-এর নীচে থাকতে হবে। এখানে রোগীদের মনে একটা প্রশ্ন থাকে যে প্রেসারের জন্য কটা ওষুধ খেতে হবে সেই বিষয়ে। এখানে বলব রোগীর রক্তচাপ 130-এর নীচে রাখতে গেলে চিকিৎসক যে কটি ওষুধ লিখে দেবেন অর্থাৎ সেটা একটা বা দুটো অথবা তিনটেও হতে পারে। সেটা সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। কারোর হয়তো একটা ওষুধেই নিয়ন্ত্রণে এসে গেল, কিন্তু অন্যজনের সেখানে তিনটে ওষুধ লাগল। তাতে কোনো অসুবিধা নেই।


এবার আসি ধূমপান প্রসঙ্গে। আগে লোকে ভাবত যে এর ফলে হার্টের অসুখ বা ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে। পরবর্তীকালে দেখা গেছে ট্যোবাকোর মধ্যে যে টক্সিন থাকে সেটাও কিডনির ক্ষতি করে।

এছাড়া কিডনির কিছু কিছু অসুখ যা যেকোনো মানুষেরই হতে পারে। যেমন ক্রনিক গ্লোমেরুলাস নেফ্রাইটিস। এর প্রাথমিক কতকগুলি উপসর্গ আছে। যেমন, পা ফোলা, চোখের কোণা ফুলে যাওয়া, প্রস্রাবের রঙের পরিবর্তন ইত্যাদি।


ওষুধে পার্শপ্রতিক্রিয়ায় কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এরকম কয়েকটা ওষুধের মধ্যে সব থেকে ক্ষতিকর ব্যথার ওষুধ। তাই কথায় কথায় ব্যথার ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। তবে ব্যথার ওষুধ হিসাবে প্যারাসিটামল 500 বা 650 চলতে পারে। এটা মোটামুটি নিরাপদ ওষুধ। আবারও বলি চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া নিজেরা কখনোই ব্যথার ওষুধ কিনে খাবেন না।


প্রথমে অ্যাকিউট কিডনি ডিজিজ থেকে ক্রমে ক্রনিক কিডনি ডিজিজে পরিণত হয়। আরেকটা কারণ থেকে কিডনির অসুখ হতে পারে। যাতে মানুষের কিছু করার থাকে না। সেটা হল পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ। এই ধরনের রোগী এলে আমরা তার পারিবারিক ইতিহাস জানার চেষ্টা করি। দেখা যায় যে ব্যক্তি এসেছেন তিনি তো কিডনির অসুখ নিয়েই এসেছেন। কিন্তু তার বাড়ির অন্যরা কোনো পরীক্ষা করাননি। তাই কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে জেনে নিয়ে কোনো সন্দেহ হলে অন্য সদস্যদের আলট্রাসনোগ্রাফি করাতে হবে। কারণ বাড়িতে বাবা বা মায়ের পলিসিস্টিক কিডনি থাকলে তার ছেলেমেয়েরও তা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ree

অ্যাকিউট কিডনি ডিজিজের কারণ:

প্রথম যে কারণটা উল্লেখ করব তার উল্লেখ আগেই করেছি তা হল ব্যথার ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা।

দ্বিতীয়ত, শরীরে কোনো ধরনের সংক্রমণ থেকে অ্যাকিউট কিডনি ডিজিজ হতে পারে। এটা পেটের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া বা ম্যালেরিয়া থেকেও হতে পারে। এছাড়া বর্তমানে অতিমারিতে কোভিড-19-এর কারণে অ্যাকিউট কিডনি ডিজিজ দেখা গেছে। এই করোনাকালে আমরা এমন অনেক রোগী পেয়েছি যারা করোনা আক্রান্ত হয়ে পরে অ্যাকিউট কিডনি ডিজিজের শিকার হয়েছেন।


ক্রনিক কিডনি ডিজিজে করোনা যোগ:

এ বিষয়ে বলি যে করোনা আক্রান্তদের অ্যাকিউট কিডনি ডিজিজ হলেও ক্রনিকের ব্যাপারটা একটু আলাদা। সাধারণত যারা ক্রনিক ডিজিজ যেমন ডায়াবেটিসে ভোগেন তাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় কম থাকে। সেক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত শর্করার কারণে তাদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ থাকলে তা করোনো সংযোগে মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়।

ree

অন্ধ বিশাস ও কিডনি ডিজিজ:

কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে কোনো মানুষের পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে চিকিৎসককে না জিজ্ঞাসা করেই যেসব টোটকা বা ওষুধ ব্যবহার করা হয় তা অসুখ নিরাময়ের বদলে দ্রুতগতিতে বাড়িয়ে দেয়। যেমন একজন রোগী যার ডায়াবেটিস আছে কিন্তু তার কিডনি যতটুকু প্রভাবিত হওয়ার কথা তার থেকেও বেশি প্রভাবিত হয়ে খারাপ হয়ে গিয়েছে। খুব স্বাভাবিক কারণেই তার একটা ইতিহাস অর্থাৎ তার জীবনধারণ, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি জানবার প্রয়োজন হল। এতে দেখা গেল কেউ একজন তাকে পরামর্শ দিয়েছে যে মাছের পিত্তথলি যেটা অত্যন্ত তেতো সেটা খেলে ডায়াবেটিস ভালো হয়ে যাবে। শরীরে যেহেতু চিনির পরিমাণ বেশি তাই যেকোনো তেতো জিনিস খেলেই বোধহয় অসুখ ভালো হয়ে যাবে। এরকম ধারণা প্রচলিত আছে। যথারীতি তিনি ওই পিত্ত খেতেন এবং ফলাফল যা হওয়ার তাই হল, কিডনিটা খারাপ হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, তার দেখাদেখি আরও কয়েকজন এই পদ্ধতি ব্যবহার করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সে সময় বেশ কয়েকজন রোগী এই একই সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন যারা এই ধরনের টোটকার বশবর্তী হয়েছিলেন। আসলে পিত্তথলির মধ্যে এমন কিছু কেমিক্যাল আছে যা কিডনিকে খারাপ করে দেয়। এরকম সাতজন রোগীর মধ্যে ছয়জনকে অ্যাকিউট কিডনি ডিজিজের চিকিৎসা করে সুস্থ করা গেলেও একজন মাল্টি অর্গান ফেলিওর হয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার হলেন।


কিডনি ডিজিজের কিছু উপসর্গ:

বয়স্ক পুরুষ রোগী যাদের প্রস্টেটের সমস্যা আছে তাদের প্রস্রাব বাধা পেয়ে আটকে যায়, অল্প অল্প হয়। ফলে তাদের প্রস্রাব অনেকক্ষণ জমে থাকে, রাতে বারবার যেতে হয়। আবার মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিভিন্ন কারণে তারা প্রস্রাব দীর্ঘক্ষণ চেপে রাখেন। এর ফলে অনেক সময়ই তারা ক্রনিক কিডনি ডিজিজের শিকার হয়ে যান। এই ধরনের রোগী পেলে আগে ক্যাথিটার পরিয়ে তার প্রস্রাব বার করে দিয়ে কিডনির কাজটা স্বাভাবিক করে পরে ধীরে ধীরে তার বাধার কারণটা খুঁজে বার করে চিকিৎসা করতে থাকি।


এখানে একটা বিষয় বলে রাখি যে যাদের প্রস্টেট সমস্যা তারাও রাতে বারবার প্রস্রাব করতে ওঠেন। সেক্ষেত্রে তাদের প্রস্রাবের পরিমাণ খুব কম হয়। কিন্তু যাদের ক্রনিক কিডনি ডিজিজ আছে তাদের যতবার প্রস্রাব হয় তার পরিমাণ অনেক বেশি থাকে।

ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে


কী ধরনের চিকিৎসা

ডায়াবেটিস রোগীদের শুধুমাত্র রক্ত পরীক্ষা অর্থাৎ রক্তে শর্করার পরিমাপ করলেই হবে না, সেই সঙ্গে প্রস্রাবের মাইক্রোঅ্যালবুমিন পরীক্ষাও করিয়ে নিতে হবে। এই পরীক্ষা করে যদি কিডনির কিছু সমস্যা ধরা পড়ে তবে ওষুধ দিয়ে কিডনির অসুখটাকে নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু যদি প্রস্রাবে অ্যালবুমিনের মাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকে তাহলে চিকিৎসকের লক্ষ্য হল সেই বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে ধীর লয়ে নিয়ে আসা।


জল-খাওয়ার ভূমিকা

কিডনিকে ভালো রাখতে জলের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। এখানে প্রথমেই বলব ডিহাইড্রেশন থেকে সাবধান। অনেক রোগী জল খাওয়ার পরিমাণ জিজ্ঞাসা করেন। এখানে বলি, যারা খুব পরিশ্রমের কাজ করেন, যাদের প্রচুর ঘাম হয় তাদের জল বেশি খেতে হবে। সেটা তিন থেকে সাড়ে তিন লিটার পর্যন্ত হলে ভালো হয়। এছাড়া স্বাভাবিক মানুষ অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার জল খেলে ভালো। খাবার প্রসঙ্গে বলি, যাদের কিডনির অসুখ হয়নি তাদের খাবারের ওপর বেশি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন নেই। তবে কিডনির অসুখ হলে অসুখের গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করে জল বা খাবার খেতে হবে। কোনো রোগীর শরীর যদি ফুলে যায় তাহলে তার জল খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে। তবে জল খাওয়ার পরিমাণ কিন্তু নিজে কমালে চলবে না। এটা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই কম-বেশি করতে হবে।


কারো কিডনির অসুখ হল তাকে আমরা প্রোটিন কম খেতে বলি। অতিরিক্ত প্রোটিন কিডনির ক্ষতি করতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো মানুষের শরীরের ওজনের প্রতি কেজিতে 1 গ্রাম প্রোটিন দরকার প্রতিদিন। সেখানে কিডনি রোগীর ক্ষেত্রে 0.6 বা 0.8 গ্রাম প্রতি কেজি হিসাবে প্রোটিন খেতে হবে।


কিডনির অসুখের ক্ষেত্রে পটাশিয়াম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যাদের কিডনির অসুখের জটিলতা আছে তাদের ক্ষেত্রে পটাশিয়ামের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কারণ এটা তাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। এমনিতে প্রায় সব ধরনের ফলের মধ্যেই পটাশিয়াম থাকে। তার মধ্যে আপেল, পেঁপে, পেয়ারার মধ্যে পটাশিয়াম থাকে কম। কিডনির রোগীদের আমরা তাই বলি যে এই তিনটি ফল ছাড়া অন্য কোনো ফল খাবেন না। এছাড়া কাজু, কিসমিস, বাদাম, আলু এগুলোর মধ্যেও পটাশিয়াম বেশি পরিমাণে থাকে। ডায়াবেটিস না থাকলেও যদি কেউ কিডনির অসুখে ভোগেন তার আলু খাওয়া চলবে না। শাকেও পটাশিয়াম বেশি থাকে। এছাড়া চাটনি, আচার ইত্যাদিও খাওয়া চলবে না একই কারণে।

ree

এত কিছুর পরেও যদি রোগীর কিডনির অসুখ ভালো হওয়ার আশা না থাকে তখন আমরা ডায়ালিসিস করার চিন্তাভাবনা করি। এক্ষেত্রে রোগীকে সাহস জোগাতে হবে যে এতে খুব আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ ডায়ালিসিস করেও অনেক রোগী চোদ্দ-পনেরো বছর বেঁচে থাকেন। আসল কথা হল ভালো জায়গায় ডায়ালিসিস করালে সুফল অবশ্যই মিলবে।


কিডনি: নীরব রক্ষাকর্তা


মানবদেহ একটি জটিল ও বিস্ময়কর যন্ত্র। এই যন্ত্রের প্রতিটি অঙ্গই নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে, কিন্তু কিছু অঙ্গ আছে যাদের গুরুত্ব আমরা প্রায়শই অবহেলা করি। তেমনি একটি অঙ্গ হলো কিডনি বা বৃক্ক। এটি একটি ছোট অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা আমাদের দেহের রক্ত পরিষ্কার রাখে, অতিরিক্ত জল ও বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয় এবং দেহে রক্তচাপ থেকে শুরু করে হাড়ের স্বাস্থ্য পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখে।


বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগের প্রকোপ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, ওষুধের অপব্যবহার – এই সমস্ত কারণেই কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ সময়মতো সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে অনেক ক্ষেত্রেই এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।


প্রত্যেক মানুষের দুটি কিডনি থাকে। এগুলো দেহের পশ্চাৎভাগে, কোমরের ঠিক উপরের দিকে, মেরুদণ্ডের দুপাশে অবস্থিত। প্রত্যেক কিডনির ওজন গড়ে ১২৫-১৫০ গ্রাম। দেখতে অনেকটা বড় শিমের মতো আকৃতির। কিডনির মধ্যে থাকে লক্ষ লক্ষ ছোট ছোট ছাঁকনি একক যাকে বলা হয় নেফ্রন (nephron)। প্রতিটি নেফ্রন কাজ করে রক্তকে পরিশোধন করার জন্য। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কিডনি প্রতিদিন প্রায় ১৫০ লিটার রক্ত ছেঁকে প্রায় ১.৫ লিটার মূত্র তৈরি করে।

কিডনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যা আমাদের দেহের স্বাভাবিক কার্যপ্রবাহ বজায় রাখতে সহায়তা করে।


রক্ত পরিশোধন: দেহের প্রতিটি কোষ থেকে আসা বর্জ্যপদার্থ রক্তে মিশে যায়। কিডনি এই বর্জ্য পরিশোধন করে মূত্রের মাধ্যমে বাইরে বের করে দেয়।


জল ও ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখা: কিডনি দেহে জল ও গুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রোলাইট যেমন সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম প্রভৃতির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে।


রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: কিডনি ‘রেনিন’ নামক একটি হরমোন নিঃসরণ করে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।


রক্ত তৈরিতে সহায়তা: কিডনি ‘ইরিথ্রোপোয়েটিন’ নামক হরমোন নিঃসরণ করে যা অস্থিমজ্জাকে লাল রক্তকণিকা তৈরি করতে উদ্দীপ্ত করে।


ভিটামিন ডি সক্রিয়করণ: কিডনি ভিটামিন ডি কে সক্রিয় করে তোলে যা হাড়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


কিডনি সংক্রান্ত রোগ সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: তীব্র (Acute Kidney Injury) এবং ধীরগতিতে হওয়া (Chronic Kidney Disease - CKD)।

তীব্র কিডনি বিকলতা (AKI):

এই অবস্থায় হঠাৎ করে কিডনি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এটি দুর্ঘটনা, মারাত্মক সংক্রমণ, রক্তক্ষরণ বা বিষক্রিয়ার ফলে হতে পারে। যদি সময়মতো চিকিৎসা শুরু হয়, তবে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

ধীরে ধীরে কিডনি বিকলতা (CKD):

এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত কিডনি রোগ, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বার্ধক্য ইত্যাদি এর প্রধান কারণ।

সাধারণত CKD ধীরে ধীরে ৫টি পর্যায়ে এগোয়। ৫ম পর্যায়ে কিডনি পুরোপুরি বিকল হয়ে যায়, যাকে বলা হয় এন্ড স্টেজ রেনাল ডিজিজ (ESRD)। তখন ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন (transplant) ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।


কিডনি রোগের উপসর্গ

প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগের তেমন লক্ষণ থাকে না। অনেক সময় রোগী বুঝতেও পারেন না যে তাঁর কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কিছু সাধারণ উপসর্গ নিচে দেওয়া হলো:

অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা

হাত-পা ও মুখে ফোলা (Edema)

প্রস্রাবে ফেনা, রক্ত বা দুর্গন্ধ

প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা ঘন ঘন প্রস্রাব

উচ্চ রক্তচাপ

চুলকানি

ঘুমের সমস্যা

রুচিহীনতা বা বমি বমি ভাব


কিডনি রোগের কারণ

ডায়াবেটিস: দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিডনির ক্ষতি করে। এটি CKD এর প্রধান কারণ।

হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ): উচ্চ রক্তচাপ কিডনির রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করে।

জিনগত সমস্যা: যেমন পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ।

নির্দিষ্ট ওষুধের অতিরিক্ত সেবন: যেমন ব্যথানাশক (Painkiller), অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার।

ইনফেকশন: বারবার মূত্রনালির সংক্রমণ কিডনিতে প্রভাব ফেলে।

ধূমপান ও অ্যালকোহল: রক্ত চলাচলে বাধা দিয়ে কিডনির ক্ষতি করে।

ree

প্রতিরোধ ও সচেতনতা

কিডনি রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা। নিচে কিছু করণীয় দেওয়া হলো:


ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন ও রক্তচাপ/রক্তশর্করা পরীক্ষা।


পর্যাপ্ত জল পান

দিনে ৮-১০ গ্লাস জল পান কিডনি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে (যদি হৃদযন্ত্রের রোগ না থাকে)।


সুষম খাদ্য গ্রহণ

প্রোটিন, লবণ ও চিনি সীমিত মাত্রায় খাওয়া, প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া।


ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা

স্থূলতা ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনের কারণ হতে পারে।


ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন

এগুলো কিডনির ক্ষতি করে।


অপ্রয়োজনীয় ওষুধ না খাওয়া

ব্যথানাশক বা অ্যান্টিবায়োটিক নিজে থেকে না খাওয়া উচিত।


নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

বিশেষ করে যাদের পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস আছে।


ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন

যখন কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায় তখন কৃত্রিমভাবে শরীর থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত জল অপসারণ করতে হয়, যাকে ডায়ালাইসিস বলে। এটি দুই ধরনের হতে পারে:


হিমোডায়ালাইসিস (Hemodialysis)

রক্ত পরিষ্কার করার জন্য একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।

পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস (Peritoneal dialysis)

পেটের ভিতর তরল ভরে বর্জ্য অপসারণ করা হয়।


চূড়ান্ত বিকল্প হিসেবে কিডনি প্রতিস্থাপন (Kidney Transplant) করা যেতে পারে। একজন জীবিত অথবা মৃত দাতার কিডনি নিয়ে তা রোগীর দেহে বসানো হয়। সফল প্রতিস্থাপনের পর রোগী অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।

ree

কিডনি আমাদের শরীরের ‘নীরব রক্ষাকর্তা’। এর যতক্ষণ না পর্যন্ত বিকল হচ্ছে, আমরা বুঝতে পারি না সে কত বড় কাজ করছে। অথচ সচেতনতা, নিয়মিত জীবনযাপন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা আমাদের কিডনি রোগ থেকে বহু দূরে রাখতে পারে।

✅ প্রতিদিন জল পান করুন

✅ নিয়মিত হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন

✅ চেকআপে কিডনি ফাংশন পরীক্ষা করুন

✅ খাদ্যে লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখুন

✅ যেকোনো উপসর্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন



সুস্বাস্থ্যের রান্না


কিডনি রোগীদের জন্য আমিষ ও নিরামিষ সুষম খাদ্য রান্না পদ্ধতি

কিডনি রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ও সুষম আমিষ এবং নিরামিষ রান্নার পদ্ধতি দেওয়া হলো। প্রতিটি রেসিপিতে কম লবণ, কম প্রোটিন ও কম ফসফরাস/পটাশিয়াম থাকার দিকটি বিবেচনা করা হয়েছে। তবে প্রতিটি রোগীর ডায়েট আলাদা হওয়ায়, এই রেসিপিগুলি ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া শ্রেয়।


আমিষ সুষম খাবার

ree

১. সেদ্ধ চিকেনের ঝোল (কম ঝাল ও লবণযুক্ত)


উপকরণ:

চিকেন (চামড়াহীন, ছোট টুকরো) – ৫০-৭৫ গ্রাম

আদা পেস্ট – ১ চা চামচ

রসুন পেস্ট – ১ চা চামচ

পেঁয়াজ কুচি – ১ টেবিল চামচ

ধনে গুঁড়ো – ১/২ চা চামচ

হলুদ গুঁড়ো – সামান্য

তেল – ১ চা চামচ

জল – ১ কাপ

লবণ – সীমিত (ডাক্তারের পরামর্শমতো)

রান্না পদ্ধতি:

একটি নন-স্টিক পাত্রে তেল গরম করে পেঁয়াজ ভাজুন।

আদা-রসুন পেস্ট দিয়ে নাড়ুন।

মসলা দিয়ে চুলায় ভেজে চিকেন দিন।

জল দিয়ে সেদ্ধ করুন ১৫–২০ মিনিট।

. ঝোলটা হালকা ও পাতলা রাখুন।

পুষ্টিগুণ: হালকা প্রোটিন, কম সোডিয়াম ও হজমে সহায়ক।

ree

২. সেদ্ধ ডিমের তরকারি (Egg White Curry)


উপকরণ:

ডিমের সাদা অংশ – ২টি

পেঁয়াজ কুচি – ১ টেবিল চামচ

আদা-রসুন পেস্ট – ১ চা চামচ

টমেটো – ১/২টি (ছাঁকা রস)

তেল – ১ চা চামচ

হলুদ/ধনে গুঁড়ো – সামান্য

জল – ১ কাপ

রান্না পদ্ধতি:

১. ডিম সিদ্ধ করে কুসুম ফেলে শুধু সাদা অংশ কেটে নিন।

২. প্যানে তেল গরম করে পেঁয়াজ-আদা-রসুন ভাজুন।

৩. মসলা ও টমেটোর রস দিয়ে দিন।

৪. ডিমের টুকরো দিয়ে হালকা ঝোল তৈরি করুন।

পুষ্টিগুণ: চর্বিহীন প্রোটিন সরবরাহ করে, কম ফসফরাস।


ree

৩. ভাপা মাছ (Steam Fish)


উপকরণ:

রুই/কাতলা মাছ – ৫০ গ্রাম

কাঁচা লঙ্কা – ১টি

সরষে বাটা – ১/২ চা চামচ

আদা কুচি – ১ চা চামচ

তেল – ১/২ চা চামচ

লবণ – খুব সামান্য

রান্না পদ্ধতি:

১. সব উপকরণ একসাথে মাখিয়ে কলাপাতা/স্টিল পাত্রে দিন।

২. ঢেকে ভাপে দিন ১৫–২০ মিনিট।

৩. তেল বা মসলা ব্যবহার কম করুন।

পুষ্টিগুণ: হালকা ও হজমযোগ্য প্রোটিন, হৃদয়বান্ধব।



নিরামিষ সুষম খাবার

ree

লাউ-চানা ডাল সেদ্ধ


উপকরণ:

লাউ কুচি – ১ কাপ

চানা ডাল – ২ টেবিল চামচ (ভিজিয়ে নেওয়া)

আদা কুচি – ১ চা চামচ

তেল – ১ চা চামচ

মৌরি/জিরা – ১/২ চা চামচ

জল – ১ কাপ

রান্না পদ্ধতি:

১. তেলে মৌরি ফোড়ন দিন, তারপর আদা ও লাউ দিন।

২. ডাল দিয়ে সব কিছু সেদ্ধ করুন।

৩. ঝোল হালকা ও পাতলা রাখুন।

পুষ্টিগুণ: কম প্রোটিন ও পটাশিয়ামযুক্ত শাকসবজি ও ডালের সঠিক সংমিশ্রণ।

ree

পালং শাক বাটা (কম পটাশিয়াম উপায়ে)


উপকরণ:

পালং শাক – ১ কাপ (পানিতে ২বার সেদ্ধ করে জল ফেলে দিন)

আদা কুচি – ১ চা চামচ

সর্ষে বাটা – ১/২ চা চামচ

তেল – ১/২ চা চামচ

রান্না পদ্ধতি:

১. সেদ্ধ করা শাক বেটে নিন।

২. তেলে আদা ও সর্ষে দিয়ে বাটা শাক দিন।

৩. ৫ মিনিট নাড়াচাড়া করে পরিবেশন করুন।

পুষ্টিগুণ: ভিটামিন A, C, আয়রনের ভালো উৎস, কিন্তু কম পটাশিয়াম রাখতে সেদ্ধ করে জল ফেলা জরুরি।

ree

৩. কুমড়ো-ডালনা (Pumpkin Curry)


উপকরণ:

কুমড়ো – ১ কাপ

পেঁয়াজ কুচি – ১ চা চামচ

আদা পেস্ট – ১ চা চামচ

তেল – ১ চা চামচ

শুকনো লঙ্কা – ১টি (ঐচ্ছিক)

জল – পরিমাণমতো

রান্না পদ্ধতি:

১. কুমড়ো ছোট টুকরো করে নিন।

২. তেলে শুকনো লঙ্কা ও পেঁয়াজ দিন।

৩. কুমড়ো ও মসলা দিয়ে সেদ্ধ করুন।

পুষ্টিগুণ: হালকা, আঁশযুক্ত ও হজমে সহায়ক।


লবণ নিয়ন্ত্রণ করুন। 

প্রয়োজনে লবণের পরিবর্তে লবণ না দিয়েই রান্না করুন।

শাকসবজি ২ বার সেদ্ধ করে ব্যবহার করুন (পটাশিয়াম কমাতে)।

প্রোটিন কমিয়ে কার্বোহাইড্রেটের দিকে ঝুঁকুন, কিন্তু ভাত বেশি না খাওয়াই ভালো।

তেল ও মসলা খুব কম ব্যবহার করুন!

 
 
 

Comments


Suswastha.png

Address: 2A Mandeville Gardens. Kolkata 700019

Email : suswastha9@gmail.com 

Follow us on

  • Facebook

© Copyright 2025, All rights reserved by Suswastha Publication. Developed by Simpact Digital (Unit of Debi Pranam)

bottom of page