গলস্টোনের আধুনিক চিকিৎসা
- সুস্বাস্থ্য প্রকাশনা
- Feb 15
- 3 min read
ডাঃ সত্যপ্রিয় দে সরকার
(গ্যাসট্রোএন্টারোলজিস্ট)

গলস্টোন নিয়ে আগেও অনেক লেখালেখি বা আলোচনা হয়েছে। রোগের যেমন পুনরাবৃত্তি হয়,আলোচনারও তেমনি হয়ে চলেছে। গলস্টোনের প্রকৃতি এক থাকলেও এখন চিকিৎসা জগৎ অনেক আপডেটেড এ বিষয়ে।

গলস্টোন হল ছোটো ছোটো দানা বা বলের আকারের মতো দেখতে পাথর, যা পিত্তবাহী নালীতে জমতে পারে বা নালীর যে কোনো অংশে জমতে পারে। মূলত পিত্তাশয় থেকে ক্ষরিত জারক রস থেকেই এগুলো তৈরি হয়।
পিত্তের বিভিন্ন উপাদানের বেড়ে যাওয়ার কারণে বিশেষ করে কোলেস্টেরল, বিলিরুবিন ইত্যাদির জন্য এই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে।আবার অনেক সময় পিত্তাশয় সংকোচনের সমস্যা থাকলে অনেকদিনের জমে থাকা পিত্ত থেকেও পাথর ফর্ম করতে পারে। এগুলোই হল গলস্টোন।

গলস্টোন থাকলে অনেক রকমের সমস্যাই হয়। গলব্লাডারে যন্ত্রণা হবে, ইনফেকশন হতে পারে। এই স্টোন পিত্তনালীর রাস্তা আটকে আরো সমস্যা তৈরি করতে পারে। এরকম চলতে থাকলে পিত্তথলি ফুটো হয়েও যেতে পারে, তার ফলে পিত্তরস সারা পেটে ছড়িয়ে পড়বে।

গলস্টোনের চিকিৎসা না হলে কোলেসিস্টাইটিস হতে পারে। জনডিস হতে পারে। প্যানক্রিয়াটাইটিসও হতে পারে কারণ লিভারের পাশেই প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয় নালী। এই স্টোন ইনটেসটিনে যাবার সময় অগ্নাশয় নালীকে আটকে দিতে পারে, এরজন্যই প্যানক্রিয়াটাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আবার ইনটেসটিনকেও আটকে দিতে পারে।

এই ধরনের সমস্যা গুলো কিন্তু ছোটোখাটো নয়। ইগনোর করলে মুশকিল। অনেকেই প্রশ্ন করেন, গলস্টোন হয় কেন? দেখুন এর উপস্থিতি প্রাথমিকভাবে তেমন বোঝা যায় না ঠিকই, কিন্তু এর তৈরির কারণগুলো খুব তাৎপর্যপূর্ণ। পরিবেশগত কারণ যেমন আছে, তেমনি কোলেস্টেরল জমা হওয়ার প্রবণতা বাড়লে হতে পারে। আবার ডায়বেটিসের কারণে হতে পারে। লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে গেলেও হতে পারে। আমাদের দেশে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণেও পিত্তথলিতে পাথর হতে দেখা গেছে। কারণ যাই হোক ফল কষ্টকর, আর এর থেকে চরম সত্যি তো কিছু নেই। এই রোগের সেরা চিকিৎসা হল অপারেট করা। ফেলে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অপারেশন করতে হবে।

ল্যাপারোস্কোপিতে পাথর বের করা হয়। এখন রোবোটিক ল্যাপারোস্কোপিও হয়, কলকাতাতেই হচ্ছে। আগে এই বিষয়ে সেরকম কোনো প্রপার পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, এখন অবশ্য অনেক অ্যাডভান্স হয়েছে। আগে সাকরেদি করে শিখতে হতো, কিন্তু গত চার বছর ধরে সার্জিকাল অ্যাসোসিয়েশন এন্ডোস্কোপি ফেলোশিপ শুরু করেছে। যেখানে সার্জেনরা এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত হতে পারছেন। পোষ্ট এম.এস এর তিনবছর পর এটা অ্যাপিয়ার করা যায়। এবছর থেকে এন্ডো সার্ক-21 স্ট্রাকচার ট্রেনিং শুরু হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশের সার্জেনরা এই কোর্স করতে পারবেন । যেখানে এন্ডোস্কোপি, থেরাপিউটিক এন্ডোস্কোপির ফর্মাল ট্রেনিং হবে।
এসব তো আগে ছিল না। দিনে দিনে উন্নতি হচ্ছে। রাজমুন্দ্রির জি.এস.এল মেডিকেল কলেজে কয়েক কোটি টাকার মেশিনপত্র এসেছে, যেখানে মানুষের ওপর এক্সপেরিমেন্ট নয়, মেশিনের ওপর বসেই ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং শুধু রোগ আর তার প্রতিকার জানলেই তো হবে না, কোথায় কী উন্নতি হচ্ছে তাও জানতে হবে। এখন অনেক ইজি হয়েছে বিষয়টা।

যাক আবার আলোচনায় ফিরি। আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি যে, গলস্টোনের ক্ষেত্রে তেমন উপসর্গ থাকে না, তবে যদি ওই পার্টিকুলার জায়গায় ব্যথা অনুভব করেন, খাওয়ার পর পেটটা ভার লাগে, হালকা ব্যথা আসতে শুরু করে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখি, স্টোন হয়েছে বুঝতেও পারে না, অন্য কোনো টেস্ট করতে গিয়ে ধরা পড়লো। তবে যাই হোক অপারেশন করাতে হবে। গলস্টোন থেকে বাঁচতে গেলে ওজন আয়ত্বের মধ্যে রাখতে হবে। তারজন্য ব্যায়াম করতে হলে করুন। মূল কথা হল ফ্যাটসেলকে কমাতে হবে। বেশি তেল মশলাযুক্ত খাবার খাবেন না।

গলস্টোন (Gallstone) বা পিত্তথলির পাথরের আধুনিক চিকিৎসা প্রধানত রোগীর উপসর্গ, পাথরের আকার ও সংখ্যা, এবং জটিলতার উপর নির্ভর করে। বর্তমানে গলস্টোনের চিকিৎসায় নিচের পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা হয়—
১. ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা (Conservative Treatment)
- যদি গলস্টোন ছোট হয় এবং কোনো উপসর্গ সৃষ্টি না করে, তবে চিকিৎসক ওষুধের মাধ্যমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
- Ursodeoxycholic acid (UDCA) বা Chenodeoxycholic acid (CDCA) ব্যবহার করে গলস্টোন গলানোর চেষ্টা করা হয়, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং সব রোগীর ক্ষেত্রে কার্যকর নাও হতে পারে।
২. ল্যাপারোস্কোপিক কোলেসিস্টেকটমি (Laparoscopic Cholecystectomy)
- এটি গলস্টোন অপসারণের সবচেয়ে আধুনিক ও কার্যকর পদ্ধতি।
- ছোট ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে ক্যামেরা ও অস্ত্রোপচার সরঞ্জাম প্রবেশ করিয়ে সম্পূর্ণ পিত্তথলি (Gallbladder) সরিয়ে ফেলা হয়।
- ব্যথা কম হয়, দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়, এবং হাসপাতালে থাকার সময়ও কম লাগে।
৩. ওপেন কোলেসিস্টেকটমি (Open Cholecystectomy)
- যদি গলস্টোনের কারণে গুরুতর সংক্রমণ, বড় পাথর বা অন্যান্য জটিলতা (যেমন— গলব্লাডার ফেটে যাওয়া বা ক্যান্সারের শঙ্কা) দেখা দেয়, তবে পেট কেটে ওপেন সার্জারি করা হয়।
- এটি তুলনামূলক বেশি জটিল এবং সুস্থ হতে বেশি সময় লাগে।
৪. এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড কোলানজিওপ্যাঙ্ক্রিয়াটোগ্রাফি (ERCP)
- যদি গলস্টোন পিত্তনালীতে (Common Bile Duct) আটকে যায় এবং বাধা সৃষ্টি করে, তবে ERCP পদ্ধতির মাধ্যমে এন্ডোস্কোপ ব্যবহার করে পাথর অপসারণ করা হয়।
- এটি সাধারণত সেই রোগীদের জন্য যারা উচ্চ ঝুঁকির কারণে সম্পূর্ণ গলব্লাডার অপসারণ করতে পারবেন না।

৫. শকওয়েভ লিথোট্রিপসি (Extracorporeal Shock Wave Lithotripsy - ESWL)
- খুব কম ক্ষেত্রে, যদি পাথর ছোট এবং সংখ্যা কম হয়, তবে ESWL ব্যবহার করে উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে পাথর ভেঙে ছোট ছোট টুকরো করা হয়, যা পরে প্রস্রাব বা মলের সঙ্গে বের হয়ে যেতে পারে।
- তবে এটি খুব কম ব্যবহৃত হয় এবং সব রোগীর জন্য কার্যকর নয়।
- গলস্টোনের স্থায়ী চিকিৎসা সাধারণত ল্যাপারোস্কোপিক কোলেসিস্টেকটমি ।
- উপসর্গহীন গলস্টোন থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পর্যবেক্ষণে থাকা যেতে পারে।
- খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও পর্যাপ্ত জল পান করে নতুন গলস্টোন হওয়া প্রতিরোধ করা যায়।

Comments