top of page

হাঁপানির রোগীরা সুস্থ থাকতে কী খাবেন?

  • সুস্বাস্থ্য প্রকাশনা
  • May 1
  • 5 min read

ডা: শৌভিক বর্মণ

(বিশিষ্ট বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ)

ree

হাঁপানির সঙ্গে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত। তাই যেকোনো মানুষকে হাঁপানির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেই তিনি দমের কষ্টের ইঙ্গিত দেবেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সবাই ভাবতেন যে এটা বয়সকালের অসুখ। বৃদ্ধ ব্যক্তিদের এই রোগ হওয়াটা স্বাভাবিক। আর সেই সঙ্গে মানুষ এটাও ভাবতেন যে এই রোগ হলে আর সারে না। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এই বিশ্বাসটা যে সার্বিকভাবে সত্য এ কথা বলা যায় না। বরং বলা যায় যে একটা সুস্পষ্ট আলোর রেখা ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি যাতে রোগটার কাছে আত্মসমর্পণ না করে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার অস্ত্রশস্ত্র আমাদের কিছুটা আয়ত্তের মধ্যে। আজকের প্রতিবেদনে এই কথাই আপনাদের কাছে তুলে ধরব।

ree

হাঁপানি কী?

আমাদের বুকে দুটো ফুসফুসের মধ্যে শ্বাসনালী রয়েছে। এই শ্বাসনালী যদি সরু হয়ে যায় তবে তার মধ্যে স্বাভাবিক বাতাসের যে প্রবাহ তা চলাচলের ব্যাঘাত ঘটে। এই অবস্থায় শরীরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কম পরিমাণে ঢোকে এবং শরীরের মধ্যে তৈরি হওয়া পচা গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হতে পারে না। তখন শ্বাসনালী সংকুচিত হয়ে মানুষের দমের কষ্ট হতে থাকে। বিশেষত যখন মানুষ হাঁটা-চলা, কাজকর্ম বা পরিশ্রমের মধ্যে থাকে তখন এই কষ্ট বেশি হয়। তবে বসে থাকলে কষ্ট কম হয়। সমগ্র বিশ্বেই এই রোগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই রোগে প্রতি বছরই প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হন এমনকী মৃত্যুও ঘটে।


হাঁপানির পর্যায়ভাগ:

হাঁপানির দুটো পর্যায় আছে

(1) জন্মগত, জিনঘটিত বা অ্যালার্জিক হাঁপানি। এটিকে বলে অ্যাজমা।

(2) আরেকটি পর্যায় যেখানে মানুষ নিজেই দায়ী। এই পর্যায়ের হাঁপানিকে আমরা বলি সিওপিডি অর্থাৎ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ। এর মূল কারণ ধুলো, ধোঁয়া অর্থাৎ বায়ু দূষণ।

ree

হাঁপানির উপসর্গ

এই রোগের কতকগুলি সাধারণ উপসর্গ আছে। যেমন-


1.শ্বাসকষ্ট বিশেষত হাঁটাচলা, কাজকর্ম করলে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়।

2.কাশি হয়। বিশেষত রাতের দিকে এই কাশি বেশি হয়।

3.বুকে কফ জমে থাকা। কফ সবসময় বের হতে থাকে, গলায় অস্বস্তি হয়। মনে হয় গলার কাছটায় জমে আছে বা সেটা বের হতে চাইছে।

4.বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই আওয়াজ বা ঘড়ঘড় আওয়াজ। এর কারণ শ্বাসনালী সরু হয়ে গিয়ে বুকে জমে থাকা কফ ওই সরু রাস্তা দিয়ে বের হতে অসুবিধা হওয়ার জন্য ওই ঘড়ঘড় আওয়াজ হতে থাকে।

ree

হাঁপানি কতটা মারাত্মক?

হাঁপানি রোগের একটা নির্দিষ্ট বয়সকাল আছে, ছোটবেলায় অ্যালার্জি ঘটিত কারণে হয়। বয়সকালে দেখা যায়। আগে হয়তো তার ছিল না, পরে রোগটি হয়েছে। সি ও পি ডি রোগটি অবশ্য বয়সকালে হয়। সাধারণত 40 বছর বয়সের আগে এটা হয় না। ছোট বয়সে যখন এই রোগের উপসর্গগুলো দেখা যাচ্ছে তখনই চিকিৎসককে দেখানো উচিত। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, যত তাড়াতাড়ি রোগটাকে চিহ্নিত করে চিকিৎসা করা যাবে ততই তার ফলাফল ভালো হবে। রোগটা চিহ্নিত করতে দেরি হলে ফলাফল ততটা ভালো হয় না । সাধারণ মানুষজন জানেন যে হাঁপানি সারে না। কিন্তু আমরা চিকিৎসকরা এটা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি না। তাই এই ধারণাকে বলি আংশিক সত্য। হাঁপানি যদি অল্প বয়সে সময়মতো চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করা যায় তাহলে সেটা সেরে যায়।

ree

বয়সকালে যে হাঁপানি হয় সেটা সম্পূর্ণ সারে না। তবে ওষুধ দিয়ে সেই কষ্টকে কিছুটা কম করা যায়। কিন্তু ওষুধ বন্ধ করলে চলবে না, খেয়ে যেতে হবে। নাহলে পরিস্থিতি আবার খারাপের দিকে যাবে।

আবার দেখা যায় অনেকেই ভালো হয়ে যাওয়ার পর ওষুধ বন্ধ করে দেয়। আবার যখন কষ্ট হয় তখন ওষুধ খাওয়া শুরু করে। এতে দেখা যায় যে পরবর্তীকালে ওষুধটা আগের মতো কাজ করে না। বার বার রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।


নেবুলাইজারের প্রয়োজন হয়, নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াতে হয় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তারপর একসময় ওষুধ ঠিকভাবে কাজ করে না এবং তখনই তার মৃত্যুর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাই বলি, চিকিৎসকের নির্দেশ মতো ওষুধপত্র ঠিকমতো খেলে রোগী অনেক ভালো থাকে। এই অভিজ্ঞতায় আমরা বলি যে ঠিকমতো সাবধানতা নিয়ে চললে হাঁপানি কিন্তু প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে না। আবার যদি হাঁপানির সঙ্গে অন্য কোনো রোগ থাকে বা ওষুধপত্র ঠিকমতো গ্রহণ না করা হয়, জীবনযাত্রাও যদি সঠিক না হয়, তখনই হাঁপানি প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।

ree

হাঁপানিতে খাওয়া-দাওয়া:

হাঁপানির রোগী কী খাবে এবং কী খাবে না সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অ্যালার্জিজনিত যে শ্বাসকষ্ট তাতে অ্যালার্জি পরীক্ষা করে দেখা হয় যে কী ধরনের খাবার খেলে অ্যালির্জি হয়। সেক্ষেত্রে সেই সব খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো। তবে সব মানুষের একই রকম হয় না, মানুষ ভেদে সেটা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সেইসব খাবার থেকে সাবধান থাকতে হবে।


এবার বলি কী ধরনের খাবার খাবেন। সাধারণত আমরা বিভিন্ন ধরনের লেবু কমলালেবু, মুসাম্বিলেবু, পাতিলেবু খেতে বলি যেগুলোতে ভিটামিন সি আছে এবং এই লেবুর রস মানুষের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। এছাড়া যারা সিওপিডি-তে ভোগেন তাদের আমরা বলি হাই প্রোটিন-লো কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার খেতে। এটা বয়সকালে হয়।


এদের শরীরে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেট বেশি খেলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়ে শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে দেয়। কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার যেমন ভাত, রুটি ইত্যাদি কম খেয়ে সবজি, প্রোটিন জাতীয় খাবার, মিনারেলস ইত্যাদি খেয়ে পেট ভরাতে হবে। অনেক সময় রোগী বলেন যে তাড়াতাড়ি পেট ভরে যাচ্ছে এবং খাবার পরেই শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। এক্ষেত্রে আমরা বলি একসঙ্গে না খেয়ে অল্প অল্প করে বারে বারে খাওয়ার জন্য।

ree

এছাড়াও দুটি বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। কারণ এই বিষয় দুটি শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক টেনশন বা উদ্বিগ্নতা, দুই খালি পেটে থাকা। এজন্য আমরা হাঁপানি রোগীদের খালি পেটে থাকতে বারণ করি। কারণ এতে দমের কষ্ট বাড়ে। খালি পেটে থাকলে অ্যাসিড রিফ্লাক্স হয় অর্থাৎ খাবার হজম করানোর জন্য যে পিত্তরস বের হয় সেটা উপরের দিকে উঠে এসে দমের কষ্ট বাড়িয়ে দেয় বা শুকনো কাশি হতে থাকে। তাই খিদে পেলে অল্প মুড়ি, বুিট ইত্যাদি খেয়ে নিতে হবে।


যেসব খাবারে অ্যালার্জি হচ্ছে সেগুলো বর্জন করুন। বাড়িঘর, বিছানার চাদর, পর্দা পরিষ্কার রাখুন।

ধুলো, ধোঁয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখুন। মাস্ক ব্যবহার করুন। হাই প্রোটিন, লো কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার, ভিটামিন-সি, মিনারেলস যুক্ত খাবার যেগুলো স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় সেগুলো খাওয়ার চেষ্টা করুন। খুব মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন। এতে কাশির সম্ভাবনা বাড়ে। শ্বাসকষ্ট যখন বেশি থাকে তখন কাঁচা লঙ্কা, তেতুল ইত্যাদি খাবার খেলে আমাদের শ্বাসযন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে। তাই এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।


হাঁপানি প্রতিরোধে আরও কিছু কথা

জীবনযাত্রায় বেশ কিছুটা বদল আনতে হবে। চিকিৎসক যেসব ওষুধ দেবেন সেগুলো ঠিকমতো খেতে হবে। যদি মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় কোনো হাঁপানি রোগী আসেন তখন তাকে প্রথমেই পরামর্শ দিই ধুলো, ধোঁয়াযুক্ত স্থান এড়িয়ে চলতে হবে। রাস্তায় বের হলে মাস্ক, রুমাল বা কাপড় দিয়ে তৈরি স্কার্ফ দিয়ে ভালো করে নাক ঢেকে দিতে হবে অর্থাৎ সচেতন থাকতে হবে।


বাড়িঘর পরিষ্কার রাখতে হবে। ঘরের মধ্যে অযথা স্প্রে করা, ধূপ-ধুনো জ্বালানো বা গ্রামেগঞ্জে কাঠের উনুনে ধোঁয়া বের হওয়া অবস্থায় রান্না করা এগুলো ফুসফুসের খুব ক্ষতি করে। এক্ষেত্রেও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ঘরের পর্দা, বালিশের ঢাকা পরিবর্তন করাটা বিশেষ দরকার।

যেসব খাবারে অ্যালার্জি হয় সেগুলোর পরিবর্তন করতে হবে।


ree

ওষুধের ক্ষেত্রে বলব হাঁপানির সব থেকে কার্যকরী ওষুধ ইনহেলার। এটাই একমাত্র ওষুধ যা শ্বাসের কষ্ট থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। কম বয়সে ইনহেলার ব্যবহার করলে রোগটা একেবারে সেরে যায়। তবে বেশি বয়সে একেবারে সেরে না গেলেও ইনহেলার দিয়ে রোগটাকে খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তখন অন্য কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না, ইনহেলার দিলেই চলে। এর ওপরই বেশি জোর দিলে অন্য ওষুধ ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে।

ইনহেলার প্রতিদিনই নিতে হবে, বন্ধ করলে চলবে না। ভালো হয়ে গেলেও এটা নিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না চিকিৎসক বন্ধ করতে বলছেন। আবারো বলছি যে, বয়স বেশি হলে বা দেরিতে রোগটা ধরা পড়লে ইনহেলার নিয়ে যেতে হবে, বন্ধ করলে চলবে না। তবে শুধু শ্বাসকষ্ট নয়, এর সঙ্গে হাঁচি, নাক দিয়ে জল পড়া ইত্যাদি উপসর্গ থাকে বলে কিছু অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ দেওয়া হয়।

হাঁপানির ক্ষেত্রে ফুসফুসের একটা পরীক্ষা আছে পিএফটি (পালমোনারি লাঙ ফাংশন টেস্ট) যা দেখে দেখে ডোজ কমিয়ে কমিয়ে তারপর প্রয়োজনবোধে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়।


সবশেষে বলি, হাঁপানিতে মৃত্যুহার বেশি হলেও বলব এর কারণ অনেকটাই অসচেতনতা। যদি সময় মতো রোগটিকে চিহ্নিত করে সঠিক চিকিৎসা শুরু করা যায় ও ওষুধপত্র ঠিকঠাক ভাবে খাওয়া হয় এবং নিজের জীবনযাত্রায় নিয়ন্ত্রণ আনা যায় তবে রোগী সুস্থ থাকে। আর অযথা ইনহেলারের বিষয়ে ভয় না পেয়ে এর ব্যবহার করুন যা আপনার ফুসফুসকে ভালো রাখবে। বাড়াবাড়ি হলে নিজেরা বা ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাবেন না। চিকিৎসকের প্রয়োজনীয় মতামত নেওয়ার চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে আরও একটা অনুরোধ রইল যে আমরা প্রত্যেকে আমাদের পরিবেশকে সুন্দর, দূষণমুক্ত রাখার চেষ্টা করব এবং যতটুকু সম্ভব বৃক্ষরোপণ করে সবুজায়ন করার চেষ্টা করব। কারণ এখান থেকে প্রাপ্ত নির্মল অক্সিজেন পৃথিবীর প্রত্যেককে সুস্থভাবে বাঁচার ঠিকানা দেয়। ওয়ার্ল্ড অ্যাজমা ডে’র সংকল্প পৃথিবী থেকে এই রোগটিকে মুছে ফেলতে হবে। আমরাও সেই সংকল্পকে বাস্তবায়িত করার পথে এগিয়ে চলেছি।

 
 
 

Comments


Suswastha.png

Address: 2A Mandeville Gardens. Kolkata 700019

Email : suswastha9@gmail.com 

Follow us on

  • Facebook

© Copyright 2025, All rights reserved by Suswastha Publication. Developed by Simpact Digital (Unit of Debi Pranam)

bottom of page